ঈশ্বরের খিদে
– অমরেশ কুমার
ছোট পরিবার, ছোট সংসার
ছোট ঘর বাড়ি, ছোট যে দুয়ার
পিতা-মাতা নাই , স্বামী-স্ত্রী রয়
পুরো পরিবার আনন্দময় ।
কাটিল কিছুদিন, বাড়িল কিছু স্মৃতি
আসিল ঘরে নতুন অতিথি;
জীবন যেন আরো মধুময় হয়
খুশিতে দম্পতি আত্মহারা রয় ।
মায়ের আঁচল তলে শুয়ে
বলছে যেন কোলের শিশু —–
“মাগো! তুমি এত খুশি কেন আজ
আমি কি দিলাম তোমায় কিছু?”
কিভাবে বুঝিবে সে বালক
কি পাইলো তাহার মা;
মা, বক্ষে জড়ায়ে কহিলেন—-
” ওরে বাছা,
দশ মাস দশ দিন গর্ভে করেছি ধারণ তোরে
যাইছিনু প্রসবকালে মরে,
বহু প্রতীক্ষার পরে, শত শত জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করে
তুই এসেছিস মোর কোলে
আনন্দ সহকারে, নৃত্যের তালে
তাইতো দুলাইতেছি তোরে দুলে দুলে।”
খিলখিলিয়ে হাসছে শিশু
বলছে মারে,” তোকে ছেড়ে
যাবো না মা থাকবো চিরকাল।”
মায়ের মুখের রাঙা হাসি
উঠল আবার ফুটে ,সম্মুখে
আনিয়া লইলো হাতের
মুঠে । মুখপানে চাহি
করুণা নয়নে কহে, “কোথা
যাবি বাবা, আমায় ছাড়িয়া ?
মোর তো একটাই আশা
শুধু তোকে দেখিব দু’নয়নে
ভুলিব সকল ব্যথা; লইয়া
তোরে শান্ত- বক্ষ -পানে।।”
মায়ে- ছেলে হেসে খেলে
দিন কাটে আনন্দে ডানা মেলে ।
দিন যায় রাত যায়
সে গুটি গুটি পায়ে হামাগুড়ি দেয় ।
মা পিছু পিছু ছোটে
আর বলে,” দেখোনা,
তোমার ছেলে হয়েছে কেমন ছটফটে ।”
সারা বাড়ি জুড়ে, তোলপাড় করে
ধরিতে গেলে মা, বলে– “পারিবেনা তুমি
আমি ছুটিব আরো জোরে ।”
মায়ের দিকে চেয়ে
বাবা, কহে হেসে—” মা হওয়া কি মুখের কথা ?
বুঝিয়ে দেবে ঘাড়ে তোমার কটা মাথা “।
মাও হেসে কহে —
“সব মায়েরাই চায়
তার সন্তানের দুষ্টুমি সেও যেন পায় ।।”
ছোট্ট এই পরিবারে আনন্দ আরো বাড়ে
সন্তানের মুখে প্রথম মা ডাক শুনে ।
আনন্দে মেতে উঠে মায়ের প্রাণ
হাজার সুখের মাঝে মা যেন
খুঁজে পান মাতৃত্বের সন্ধান
পূর্ণ হল মায়ের আশা, পূর্ণ হল মন
মা যেন হাতে পেল সাত রাজার ধন ।।
বছর তিনেক কাটিয়া গেল
এমন খুশির রেসে
হাসিতে হাসিতে সন্তান বাড়িয়া উঠে
মায়ের চারিপাশে ।
চিন্তা বাড়িল মায়ের বক্ষ বাসে
আসিল বিপদ অবশেষে
ঈশ্বর মেটাইলো ক্ষিদে স্বার্থের সংঘাতে ।।
ঈশ্বর কর্তৃক, নামিল প্রবল বর্ষণ
রুদ্রধারি প্রকৃতি সংহারী
থামিলোনা আর এ চির বর্ষণ ;
টানা তিন মাস,
মাঠ ঘাট নদী নালা পুরো থৈ থৈ
পাড়া নিরিবিলি করিছে না কেউ হইচই ।
অবশেষে থামিল এ ধ্বংসের বৃষ্টি
চারিদিকে শুধু জল, যত দূর যায় দৃষ্টি ।।
বাবা কহে, “ ওগো, এ কাল বর্ষণ কমিয়াছে
চারিদিকে শুধু জল জমিয়াছে,
তুমি ছেলেকে রেখো সাবধানে ;
এই রহিলো ছেলে, যাচ্ছি কাজে চলে ।”
বাবা বাহির চলে যায় ,
যাবার কালে ছেলের মুখে
হামি দিয়ে যায় ।।
ফুটবল লয়ে উঠানে ছুটে
ঘুরে ঘুরে খেলে বেড়ায় ছেলে ;
মা বসে বসে রান্না করে ,আর তাকিয়ে দেখে,
কিভাবে ছেলে ফুটবল লয়ে খেলা করে ।
বাবা চলে যেতে দেখে, ছেলে
পিছু পিছু ছোটে,
এড়িয়ে যায় মায়ের নজর ।।
ছেলে ছুটে চলে, বাবা বাবা বলে
গুটি গুটি পায়ে , যায় সে বাবার দিকে;
কিছুদূর গিয়ে, মনে বাধা পেয়ে
ফিরে আসে বাবা ।
ফেরা পথে দেখে, রাস্তার পাশে
কচুরিপানার ঝিলে
জলসহ পানা নরিছে একই তালে ।
বাবা , রাস্তা দিয়ে চিৎকার করে
বউকে শুধাই, “ওরে , আমার বর্ষা খানা
নিয়ে আয় । কচুরিপানার ঝিলে
বড় মাছ যে খাবি খায় । ”
রান্না ফেলে , ছেলেকে ভুলে
ধরিতে আসে মাছ ; বলে,
“ কি গো, ফিরে এলে আজ,
নাহি কি আজ কোনো কাজ ?”
বর্ষা হাতে লয়ে বলে,
“ চুপ চুপ কোন কথা নয় ,
শব্দে পালিয়ে যাবে,
ঠিক করে মারা চায় । ”
তাক করে ছুড়িল বর্ষা ,
স্ত্রীর মুখপানে চেয়ে
হেসে হেসে কহে,
“ একদম ঠিকঠাক করিয়াছি তাক ,
পারিবেনা পালাইতে, রাখেনি কোন ফাঁক ।”
হাসি হাসি মুখ করে বলে,
“ দেখি ! তোলো,
বর্ষায় কি মাছ বিঁধিল ।”
সন্তর্পনে তুলিল বর্ষা
বিঁধিয়া রহিয়াছে তাহারি সন্তান ,
বর্ষার ফলা –
বিঁধিয়া আছে হৃদপিণ্ড দিয়া
রক্ত ঝরিছে ঝরঝরিয়া
এখনও , রহিয়াছে শেষ প্রাণ
ডাকিছে মা- মা বলিয়া ।
ফাটিল মায়ের কোমল বুক
উড়িলো মাতৃত্বের সকল সুখ ।
হাত বাড়ালো মা ,
সন্তানকে লইবে কোলে
পড়িল মা মূর্ছা
এ ধুলার ধরণীতলে ।।
পিতা !
করুন নয়নে চাহে ,
শিশুকে রাখলি মায়ের পাশে
রক্তে ভাসিছে চারিপাশ ।
সন্তানের বুকে হাত রাখিয়া কহে ,
“হে ঈশ্বর, এই ছিল মোর ভাগ্যে
নিজ হাতে মারিলাম নিজ সন্তানকে,
আজ আমি হলাম খুনি পিতা ,
ফুলের মত আমার শিশুকে
আমি তুলিলাম চিতায় ;
যে শরীর দিয়া জন্ম দিয়েছে তারে ,
তারে ফেলিলাম নিজে মেরে ,
যে হাতে ঝিনুক বাটি তুলিয়াছি মুখে
সে হাতে বিঁধিলাম ফলা , তারই বুকে
হায় ! হায় ! হায় !
একি আমি করিলাম ভুল
হায়! হায়! হায়!
এ ভুলের প্রায়শ্চিত্ত নাই!
বাঁচিবার মোরে কোন অধিকার নাই ।”
ছুটিয়া যাইলো ঘরে
দড়ি ঝুলাইয়া ঝুলিল সশরীরে
সন্তানের সাথে সাথে শেষ হইলো নিজে ।।
মায়ের মূর্ছা ভাঙ্গে
চিৎকার করিয়া উঠে,
“ওরে , বাবান কথা বল
তুই পারবিনা যেতে, আমাকে এভাবে ফেলে ।”
মা , সন্তানকে জড়াইয়া বুকে
কাঁদিতে কাঁদিতে বাড়ে বাড়ে মূর্ছা যায়
আবার , জ্ঞান ফিরিয়া পায় ।
মা , চাহিয়া রহে সন্তানের মুখপানে
পরিছে রক্ত মায়ের কোলে টোপে
রক্তে মায়ের সারা শরীর রাঙা হয়ে ওঠে ।।
চারিদিকে শুধু,
মায়ের ক্রন্দন চিৎকার ।
শুনছে না কেউ , শুধু শুনেছে
তৃষ্ণায় পিপাসু ক্ষুধার্থ ঈশ্বর ।
নাহি কোনো শব্দ তার সন্তানের মুখে,
মা , শুধু জড়িয়ে আছে সন্তানকে বুকে ।
শেষে ক্রন্দন থামাইয়া
ঈশ্বরের পানে চাহিদা বলে,
“ হে ঈশ্বর, তুমি নিয়েছো মোর সন্তানকে লয়ে
পেয়েছে কি তোমার এতটাই খিদে ?
মায়ের বুক থেকে সন্তানকে নিয়ে
মিটিলো কি তোমার তৃষ্ণার খিদে ?
বলো , হে ঈশ্বর,
মিটিলো কি তোমার রক্তের পিপাসা ?
নাকি, এখনো করিবে পান —–
রহিয়াছে কি বুকে এখনও তৃষ্ণার আশা ?
কেন তবে রহিয়াছো চুপ করে
নেই কেন মুখে কোন ভাষা —?” ।।
নিশ্চুপ,
মা, আকাশ পানে চাহিয়া কয়
“ও ! এখনো মেটেনি তোমার আশা, হে বিধাতা ! ”
সন্তানের বুক দিয়া উঠাইয়া ফলা
সজোরে নিজ বুকে আঘাত মারিয়া কহে ,
“ নাও, তবে করো পান,
মেটাও তোমার রক্তের পিপাসা ” ।।
খুবই সুন্দর কবিতা কবি। খুব ভালো লাগলো